আজ যে আমেরিকা বুক ফুলিয়ে সারা বিশ্বে শান্তির বার্তা ছড়াচ্ছে, সেই আমেরিকাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে প্রায় ১০ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কখনও কোন দেশের কাছে এই কাজের জন্য ক্ষমা চায় নি। আমেরিকার অপকর্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, তারা দুই পক্ষকেই অস্ত্র শস্ত্র বিক্রি করছিল, কারন আমেরিকার একটিই শ্লোগান আর সেটা হল , আপনা কাম বানতা, ভার মে যায় বাকি দুনিয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা দুই পক্ষকেই হাতিয়ার বিক্রি করছিল, এবং নিশ্চিন্তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখছিল, কিন্ত সেই হাতিয়ার দিয়েই যখন জার্মানি আমেরিকার অনেক গুল জাহাজ ডুবিয়ে দেয়, তখন আমেরিকা চলে আসে মানবতাকে রক্ষা করতে।
![বাদিক থেকে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, ইউএসএসআরের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টালিন ( Source - Britannica )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/Franklin-D-Roosevelt-Joseph-Stalin-Churchill-Allied-February-1945.webp)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ঠিক একই ঘটনা সামনে আসে, প্রথমে তো আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বজুদ্দে অংশগ্রহন করেনি, এবং জাপানকে যুদ্ধের জন্য তেল এবং অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করছিল, কিন্তু এরই মধ্যে জার্মানি আমেরিকার উপর হামলা করে দেয়, তখন আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহন করে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে হিটলার ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব থেকে বড় অপরাধি, যে প্রায় ২কোটি মানুষকে সরাসরি হত্যা করেছিল। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে আমেরিকার কাজ গুলও কিন্তু হিটলারের থেকে কম ছিল না, আমি এখানে হিটলারের অপরাধ গুলকে জাস্টিফাই করছি না, আমি শুধু হিটলারের সাথে আমেরিকার তুলনা করছি। আর এর কারন হল জাপানের উপর পারমানবিক বোমা ফেলা।
![জাপানে পরমানু হামলার পরের দৃশ্য ( Source - NBC News )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/200804-hiroshima-dome-mn-1546.jpg)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে, জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছিল, কিন্তু তখনও জাপান যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এই সময়ে জাপানকে রুখতে আমেরিকা জাপানের দুট শহরের উপরে পারমানবিক বোমা ফেলে, হিরোশিমা যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল তাতে প্রায় ১ লক্ষ ২৯ হাজার মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল সাধারন মানুষ, তবে আমেরিকা একটা বোমা ফেলে শান্ত ছিল না, ঠিক তিন দিন পর নাগাসাকি শহরেও তারা পারমানবিক বোমা ফেলে, যাতে প্রায় ২ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ মারা যায়, এটা তো বোমার ফলে সাথে সাথে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা, এরপর যে কত মানুষ আহত ছিল, বছরের পর বছর ধরে সেখানে মানুষ বিকলংগ হয়েছে তার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। সেই সময়ে যখন মিত্র পক্ষ যুদ্ধে প্রায় জিতেই গিয়েছিল তখন জাপানের উপর পারমানবিক বোমা ফেলার কোন দরকারই ছিল না। এমনকি আমেরিকার ৩৪ প্রেসিডেন্ট ডুইট আইসেনয়ার, এটা স্বীকার করেছেন যে জাপানের উপর পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করার কোন প্রয়জন ছিল না, কারন জাপান মিত্র শক্তির সামনে টিকতে পারত না।
![জাপানে পরমানু হামলা ( Source - Wikipedia )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/Atomic_bombing_of_Japan.jpg)
আপনি কি জানেন এই জঘন্য কাজটি আমেরিকা কেন করেছিল ? কারন আমেরিকা নিজেকে একটি ওয়ার্ল্ড পাওয়ার অর্থাৎ বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী দেশ হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছিল। তাছারা সে সময়ে রাশিয়া অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমেরিকার কোল্ড ওয়ার চলছিল, তাই সোভিয়েতরা যাতে জাপানকে আক্রমন করে যাতে দখল করতে না পারে, তাই আগে থেকেই আমেরিকা পারমানবিক বোমার ভয় দেখিয়ে জাপানকে নিজের দলে টেনে নেয়। আজ সারা বিশ্বে আমেরিকাই একমাত্র দেশ যারা কোন জনবসতি পূর্ণ এলাকায় পারমানবিক বোমা ফেলেছে, এবং কয়েক লক্ষ মানুশকে হত্যা করেছে, আর আপনি জানলে অবাক হবেন আজ পর্যন্ত কখনও আমেরিকা এই কাজের জন্য অফিশিয়ালি জাপানের কাছে ক্ষমা চায় নি। হ্যা, মানবধিকারের সব থেকে বড় রক্ষকের সব থেকে বড় অপকর্মটিকে তারা একপ্রকার ভুলিয়েই দিয়েছে। তবে আমেরিকা কিন্তু এখানেই ক্ষান্ত ছিল না। চলুন দেখে নেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া আরও কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে।
কোরিয়ান যুদ্ধঃ-
![কোরিয়ান যুদ্ধে ঘর হারা শিশু ( Source - Pbs )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/superbomb-korean-war-loc.jpg__1000x724_q85_crop_subsampling-2.jpg)
১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া দখল করে নিয়েছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান যখন হেরে যায়, তখন ১৯৪৫ সালে আমেরিকা ও রাশিয়া কোরিয়াকে 38 parallel এ দুভাগে ভাগ করে দেয়, তখন নর্থ কোরিয়া আর সাউথ কোরিয়া দুটি দেশ তৈরি হয়। তবে এই দুট দেশই একে অপরের উপর দাবি করতে থাকে, মানে তারা বলত যে এই গোটা কোরিয়াই তাদের দেশ, আর তখন আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে কোল্ড ওয়ার চলছিল, আর তখন কোরিয়ায় শুরু হয় প্রক্সি ওয়ার, আমেরিকা সাউথ কোরিয়াকে হাতিয়ার দিতে থাকে যুদ্ধের জন্য, অন্যদিকে রাশিয়া আর চায়না অস্ত্র দিতে থাকে নর্থ কোরিয়াকে, আর এই যুদ্ধ ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে, এই তিন বছরে কোরিয়ায় প্রায় ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়, আর যুদ্ধের ফলাফল কিছুঈ হয়নি, আজও কোরিয়া ৩৮ প্যারালেল এ দু ভাগ হয়ে আছে, আর এই যুদ্ধে আমেরিকা যুক্ত হয়েছিল রাশিয়াকে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে, এবং এতে আমেরিকা ও রাশিয়া দুই দেশই সমান দায়ি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধঃ-
![ভিয়েতনাম যুদ্ধে অসহায় শিশুরা ( Source - Vanityfair )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/t-fb-vietnam-nick-ut-40th-anniversary.webp)
১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল, যেখান নর্থ ভিয়েতনাম ও সাউথ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধে প্রায় ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়, আর এই যুদ্ধে আমেরিকার দোষ ছিল অনেক বেশি, কোল্ড ওয়ারে এই উন্নত দেশ গুলর ক্ষমতা প্রদর্শনে ভিয়েতনামের সাধারন মানুষ গুলর জীবন নরক হয়ে উঠেছিল। রাশিয়া যেখানে ভিয়েতনামের সৈনিকদের শুধু অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছিল, সেখানে আমেরিকা যুদ্ধে নিজের সৈনিক পাঠিয়েছিল, আর এই যুদ্ধে আমেরিকার প্রায় ৫৬ হাজার সৈনিক পাঠিয়েছিল। আর ভিয়েতনামের সাধারন মানুষেরাও আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, আর দীর্ঘ ২০ বছর যুদ্ধ চলার পর আমেরিকা এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মানবতাবাদি আমেরিকা এই যুদ্ধের জন্যও কখনও ভিয়েতনামের কাছে ক্ষমা চায় নি, আর আপনি জানলে অবাক হবেন কোন পশ্চিমি দেশ কখনও আমেরিকাকে এই যুদ্ধের জন্য দোষী বলেনি।
![ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকান সৈন্য ( Source - The Atlantic )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/original-1.jpg)
আতঙ্কবাদীদের জন্মদাতা আমেরিকাঃ- বর্তমানে সারা বিশ্ব জুরে আতঙ্কবাদিদের যে সমস্যা রয়েছে, তার গোড়াতেও আমেরিকা যুক্ত আছে, রাশিয়া অর্থাৎ ততকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের উপর আক্রমন করেছিল তখন আমেরিকা আফগানিস্তানের বিভিন্ন রেবেলিয়নদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, এই রেবেলিয়নরা পরবর্তী কালে ধর্মের নামে মানুষ মারতে শুরু করে, এমনকি এরা আমেরিকার অয়াল্ড ট্রেড সেন্টারেও হামলা করেছিল, তখন আমেরিকা আবার আফগানিস্তানের উপর আক্রমন করে দেয়। আমেরিকা নিজের প্রভাব ধরে রাখতে ক্রমাগত বহু অপরাধ করেছে, আর এর মধ্যে আরেকটি হল ইরাকের যুদ্ধ
ইরাকের যুদ্ধঃ-
![ইরাকের যুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ( Source - Newstatesman )](https://romanchopedia.com/wp-content/uploads/2022/07/GettyImages-73936925-1038x778-1.webp)
২০০৩ সালে আমেরিকা হঠাত করেই ইরাকের উপরে আক্রমন করে দেয়, তখন তারা বলে ইরাক গোপনে জৈব হাতিয়ার বানাচ্ছে, যা একটি অপরাধ, তখন আমেরিকা ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা কর, এবং ইরাকের এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ ইরাকের জনগন মারা যায়। সাদ্দাম হোসেনের শাসন যে ভালো ছিল এটা আমি বলব না, কিন্তু আমেরিকা ইরাকের উপরে গিয়ে যে অত্যাচার করেছে, যেভাবে ইরাকের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে তাতে ইরাকের জনগনের জীবন সাদ্দাম হোসেনের শাসনের থেকেও বেশি খারাপ হয়ে গেছে।
আর আপনি জানলে অবাক হবেন, আমেরিকা যে কারনে ইরাকের উপরে হামলা করেছিল, মানে তারা বলেছিল ইরাকের কাছে জৈব হাতিয়ার আছে, কিন্তু যুদ্ধের পর তারা এর কোন প্রমান দিতে পারেনি যে ইরাকের কাছে জৈব হাতিয়ার আছে, এবার হয়ত আপনি ভাবছেন তাহলে এই যুদ্ধ আমেরিকা কেন করল, কারন হল সাদ্দাম হোসেন ইরাকের তেল, ডলারের বদলে বিক্রি করতে অস্বিকার করছিল, এবং তেল নিয়ে মিডেল ইস্টে আমেরিকা যে রাজনীতি করত, সাদ্দাম হোসেন তার বিপক্ষে কথা বলেছিল। তবে এই যুদ্ধের জন্যও আমেরিকার উপরে পশ্চিমি দেশ গুল কোন প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি আমেরিকাকে কখনও যুদ্ধঅপরাধি ঘোষণা করা হয়নি। এই যুদ্ধ গুল ছারাও সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন\ যুদ্ধে আমেরিকা জঘন্য অপরাধ করেছে, এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিজুদ্ধ ভারতের বিরুদ্ধে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল।
দেখুন যুদ্ধ সবসময়ের জন্যই খারাপ, আমরা কেউই যুদ্ধকে সমর্থন করিনা, তবে আজ রাশিয়া যখন ইউক্রেনের উপর হামলা করল, তখন সব পশ্চিমি দেশ গুল রাশিয়ার উপর ক্রমাগত স্যাঙ্কশন লাগিয়ে যাচ্ছে, তারা এমন ভাব করছে, যেন রাশিয়া এখন যা অপরাধ করছে, তা এর আগে কেউ কখনও করেনি, কিন্তু তারা তাদের পরম বন্ধু আমেরিকার বিরুদ্ধে একটাও শব্দ বের করে না, এটা কি ধরনের মানবিকতা, নাকি ইউক্রেনের সাদা চামড়ার মানুষ গুল আসল মানুষ, আর ইরাক, কোরিয়া জাপান, এখানের মানুষ গুলোর জীবনের কোন দাম নেই !!
বন্ধুরা আমেরিকার অপকর্মের কথা গুনে শেষ করা যাবে না, তবে আজ আমেরিকার বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলতে পারেনা, কারন তার ক্ষমতা, ডলারের ক্ষমতা, একটি দেশের অর্থব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতাই দিন দিন আমেরিকাকে অন্ধ করে দিচ্ছে, এই বিষয়ে আপনার মতামত কি আমাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানান।
আমেরিকার অপকর্ম নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুনঃ-