মাত্র ২ কিলমিটার জায়গা, কিন্তু তাতে থাকেন প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ। যা ভারত তথা এশিয়ার মধ্যে সব থেকে বড় বস্তি। এমনকি এখানে যে পরিমান মানুষ বসবাস করেন তা বহু দেশের জনসংখ্যার থেকেও অনেক বেশি। তবে মুম্বাইয়ের একদম মধ্যে খানে থাকা এই ধারাভি বস্তিটি কিন্তু ভারতের অন্যসব বস্তির থেকে বহু দিক দিয়ে আলাদা। অনেক হলিউড বলিউড মুভির শুটিং এখানে হয়, এমনকি ভারতে ঘুরতে আসা পর্যটকদের তালিকায় প্রথম সারিতে এই বস্তিটি থাকে। আপনারা জানলে অবাক হবেন শিক্ষার দিক থেকেও এই ধারাভি ভারতের বহু শহরের থেকে এগিয়ে আছে। তবে ২০০ বছর আগেও এই জায়গাটি ছিল একটা জলাভুমি, যেখানে কোন মানুষের বসবাস ছিল না। কিন্তু এবার প্রশ্ন হল একটি জলাভুমি থেকে কিভাবে এত বড় একটি বস্তি গড়ে উঠল ? এবং আজ কেন এই ধারাভি এত জনপ্রিয় ? তো বন্ধুরা আমি Mithun Adhikary রয়েছি আপনাদের সাথে আজকের প্রতিবেদনে পৃথিবীর সব থেকে বড় বস্তি ধারাভির ইতিহাস আপনাদেরকে জানাব। তাই এই প্রতিবেদনটি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত দেখুন।

**ধারাভি বস্তি গড়ে ওঠার ইতিহাসঃ-

Dharavi Slum
souce : https://www.visapourlimage.com/

সময়টা ছিল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, ব্রিটিশ সরকার ধিরে ধিরে সমগ্র ভারতকে তাদের দখলে করে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, এ থেকে বাদ যায়নি বোম্বে শহর, যাকে আমরা বর্তমানে মুম্বাই নামে জানি। সে সময়ে ব্রিটিশরা চাইছিল এই মুম্বাই শহরকে যে করেই হোক অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালি করে তুলতে হবে। সেই মত মুম্বাইয় বন্দরকে বানিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে থাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তবে তখন মুম্বাইয়ের এই ধারাভি অঞ্চলটি একটা বিশাল বড় জলাভুমি। এখানকার মানুশেরা এই জলাভুমিতে মাছ ধরে নিজেদের জীবিকা পালন করত। তবে সময়ের সাথে সাথে এই জলাভুমি শুকিয়ে যেতে থাকে। ফলে মাছ ধরে যাদের জীবিকা চলত, তারা অন্য কাজ খুজতে শুরু করে। এরপর কেটে যায় আরও বেশ কিছু বছর।

Dharavi Slum top view
Source : https://en.wikipedia.org/

এদিকে মুম্বাই শহরে দিন দিন কাজের খোঁজে বহু মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। কিন্তু যে সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে তখন ভারতের ব্যপক পরিমানে বর্ণভেদ প্রথা ছিল। যার কারনে কাজের সুত্রে আসা নিচু কাস্টের মানুশেরা শহরে থাকার জন্য জায়গা পেত না। তখন তারা এই ধারাভি এলাকায় এক জোট হয়ে থাকতে শুরু করে। যেহেতু এই জায়গাটি আগে জলাভুমি ছিল। ফলে এই জায়গার প্রতি ব্রিটিশ প্রশাসনের তেমন একটা ধ্যান ছিল না। সময়ের সাথে সাথে মুম্বাইয়ে আসা বেশির ভাগ গরিব মানুশেরা এই ধারাভিতে থাকতে শুরু করে। আর এভাবেই ধারাভি একটি বস্তির আকার নেয়।

** ধারাভির মানুষদের সংঘর্ষঃ-

Source : https://www.aljazeera.com/

ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেলে মুম্বাই ভারতের একটি বড় বানিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু ধারাভির উন্নতি তেমন ভাবে হয়নি। শুরুর দিকে এই এলাকায় ঠিকঠাক পানিয় জলের উৎস ছিল না। এখানের ছাত্র দের জন্যও ছিল না কোন স্কুল, বা শিক্ষার ব্যবস্থা, এমনকি সেসময়ের রাজনৈতিক দল গুল এই ধারাভির প্রতি কোন গুরুত্ব দিত না। তখন ধারাভির মানুশেরা একজোট হয়ে নিজেদের একটি পলিটিক্যাল পারটি গঠন করে। এরপর থেকে কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা পেতে শুরু করে ধারাভির জনগন।

বর্তমানে মুম্বাই শহরে একটি ২বিএইচকে ফ্লাটের এক মাসের ভারা প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ যারা মুম্বাই শহরে আসে নিজেদের স্বপ্ন পুরন করতে তারা এই ফ্লাটে থাকার চেয়ে ধারাভি তে সস্তায় পাওয়া ঘরকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। এখানে আপনাদের জানিয়ে রাখি রজনিকান্ত, নয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির জনি ওয়াকারের মত বহু বিখ্যাত অভিনেতারাও তাদের কেরিয়ারের শুরুতে যখন তারা মুম্বাইতে এসেছিল কাজের খোঁজে তারা বেশ কিছু বছর এই ধারাভিতে কাটিয়েছিলেন।  বহু প্রমটর এই এলাকাটিকে দখল করে নিতে চেয়েছিল, এমনকি এখানকার মানুষদের বহু টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু ধারাভির মানুশেরা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

চলুন এবার জেনে নেই ধারাভির বিষয়ে আশ্চর্য তথ্যঃ-

Source : https://www.freepressjournal.in/

ধারাভির জনসংখ্যাঃ-

বর্তমানে এই ২ বর্গ কিলমিটার এলাকায় প্রায় ১২ লক্ষেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। যা পৃথিবীর বহু দেশ যেমন ফিজি, বাহামা, গ্রিনল্যান্ড এই দেশ গুলোর থেকেও বেশি। এত অল্প জায়গার মধ্যে এত পরিমান মানুষের বসতি আশ্চর্যজনক। এখানে বসবাস করা মানুষের মধ্যে ৬৩ শতাংশ হিন্দু, ৩০ শতাংশ মুসলিম, ৬ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ১ শতাংশ অন্য ধর্মের মানুষের বসতি।  এই বস্তির মধ্য থেকেই মুম্বাইয়ের দুটি গুরুত্ব পূর্ণ রেললাইন অয়েস্ট্রারন মুম্বাই এবং সেন্ট্রাল মুম্বাই চলে গেছে। আর এর বান্দ্রা, যেখানে সব ফেমাস বলিউড অভিনেতারা বসবাস করেন।

ধারাভির শিক্ষা ব্যবস্থাঃ-

তবে একটি বস্তি এলাকা হলেও এই ধারাভিতে বহু ট্যালেন্টেড ছাত্রছাত্রী আছে। ২০১৬ সালে এই এলাকার ১৪-১৬ বছরের কিছু ছাত্রী মিলে ৩টি অয়ান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন বানিয়েছিল যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল, যার মধ্যে একটি অয়াপ হল, পড়াই হে মেরা হক, যেটি একটি পড়াশোনার অ্যাপ্লিকেশন, যা দিয়ে হিন্দি অঙ্ক, ও কিছু সাধারন বিশয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। দ্বিতীয় অ্যাপ্লিকেশনটি হল ওমেন ফাইট ব্যাক, যা মহিলাদের সুরক্ষার জন্য বানান হয়েছিল, এবং তৃতীয় অ্যাপ্লিকেশনটি হল পানি হে জীবন, এটি বানানোর উদ্ধ্যেশ্য হল, ধারাভিতে যে পানিয় জল আসে, তার জন্য এর আগে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, কিন্তু এই অ্যাপ্লিকেশনটির ফলে জল আসার ৫ মিনিট আগেই মোবাইলে মেসেজ চলে আসে, যার ফলে জলের জন্য আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। আর আপনি জানলে অবাক হবেন এই ধারাভি একটি বস্তি এলাকা হলেও এখানে শিক্ষার হার প্রায় ৭০ শতাংশ। যা ভারতের বহু উন্নত এলাকার থেকে বেশি। এর থেকে বোঝা যায় যে ধারাভির মানুশেরা পড়াশোনাকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দেয়।

ধারাভির ব্যবসা বানিজ্যঃ-

Source : https://qz.com/

এই ধারাভির ২ কিলমিটার এলাকায় ৫০০টিরও বেশি ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট আছে, যেখানে চামড়া, মাটির পাত্র, জুয়েলারি, টেক্সটাইল ইত্যাদি জিনিস ম্যানুফ্যাকচার করা হয়। আর এই এলাকায় প্রায় ১৫০০০ সিঙ্গেল রুম বিশিষ্ট কারখানা আছে, যেখানে তৈরি সামগ্রি, অনলাইনের মাধ্যমে ভারত তথা বিদেশেও বিক্রি হয়। যার কারনে প্রতি বছর এই ধারাভি থেকেই ৬৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ইনকাম হয়। যা বহু দেশের অর্থনীতির থেকেও বেশি। ফলে ভারতের অর্থব্যবস্থাতেও ধারাভির গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে এখানের প্রধান ব্যবসা হল রিসাইকিলিং, মুম্বাই শহর এমনকি এর পাশে থাকা বহু এলাকা থেকে প্লাস্টিক, গ্লাস, ও বিভিন্ন ধাতব জিনিস, যা ব্যবহারের পড়ে ফেলে দেওয়া হয়, তা এখানে আসে, আর এই রিসাইকিলিংয়ের কাজে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ যুক্ত আছে, এবং তাদের গড় আয় মাসিক ১৪-১৫ হাজার টাকা। যা ভারতের নুন্যতম লেবার কস্টের থেকে অনেকটাই বেশি।

ধারাভি রকস ব্যান্ডঃ-

Source : https://lbb.in/

আপনারা জানলে অবাক হবেন, এই ধারাভি বস্তিতে একটি ব্যান্ডও আছে, যার নাম ধারাভি রকস, এই ব্যান্ডের বেশিরভাগ সদস্যই রিসাইকিলিংয়ের কাজের সাথে যুক্ত। তবে এই ব্যান্ডটি অন্যান্য ব্যান্ডের থেকে খুব আলাদা,  যেখানে যেকোন ব্যান্ডের কাছে দামি দামি ড্রাম, গিটার, কি বোর্ড থাকে, সেখানে এই ধারাভি রকস ব্যন্ডের বাদ্যযন্ত্র কিন্তু একেবারেই আলাদা, তারা ফেলে দেওয়া জলের ড্রাম, কাচের পাত্র, কোন পুরন ধাতুর পাত্র, ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করেছে তাদের বাদ্যযন্ত্র। আর এই জিনিসটাই তাদের ব্যন্ডকে একটি আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে। এবং মুম্বাইয়ে এই ব্যন্ডটি খুবই ফেমাস।

ধারাভি টুরিস্ট ডেস্টিনেশনঃ- ভারতে প্রতিবছর বহু পর্যটক ঘুরতে আসেন। আর তারা ভারতের বহু বিখ্যাত স্থাপত্য গুল ঘুরে দেখেন। কিন্ত আপনি জানলে অবাক হবেন বিদেশি এই টুরিস্টদের ঘুরতে যাওয়ার তালিকায় একদম প্রথমের দিকেই থাকে এই ধারাভি বস্তি। ধারাভির এত সাধারন জনজীবন বহু বিদেশীদের ভালো লাগে। ফলে বর্তমানে মুম্বাইতে আসা পর্যটকদের জন্য কিছু ট্যুর গাইড অফার করা হয়, যারা এই ধারাভি বস্তিটি ঘুরিয়ে দেখায়।

ধারাভি এবং সিনেমার জগতঃ-

Source : https://www.ndtv.com/

ধারাভি এমন একটি জায়গা যার সাথে সিনেমার জগতের একটা গভির সম্পর্ক রয়েছে, ১৯৯২ সালে রিলিজ হওয়া ধারাভি সিনেমায় এই বস্তির জনজীবনকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। যার কারনে এই সিনেমাটি ন্যাশনাল অয়ারড পেয়েছিল। এছারা অস্কার জয়ি সিনেমা স্লামডগ মিলিয়নার এই ধারাভিতেই শ্যুট করা হয়েছিল। এছারা গালি বয়, সালাম বোম্বে, ভুথনাথ রিটার্ন ইত্যাদি সিনেমার শ্যুটিংও এই ধারাভিতে হয়েছিল।

এমনকি আজ মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা বহু জুনিয়র আরটিস্ট এই ধারাভিতেই বসবাস করে।

তো বন্ধুরা এই ছিল, ভারতের সব থেকে বড় বস্তি ধারাভির ইতিহাস, কেমন লাগলো এই প্রতিবেদনটি আমাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানান। আর আমাদের ইউটিউবে এবং ফেসবুকে ফলো করতে পারেন Romancho Pedia by Mithun লিখে সার্চ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *