“ডলার”এই শব্দটির সাথে আমরা স্বল্পবিস্তর সবাই পরিচিত।। এই ডলার হল আসলে আমেরিকান মুদ্রা।। যেমন ভারতীয় মুদ্রার নাম রুপি তেমনি আমেরিকার মুদ্রার নাম ডলার।। পৃথিবীর অর্থনীতির ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও শক্তিশালী মুদ্রা হল এই মার্কিন ডলার।। বিশ্বে এই ডলারের প্রভাব এতটাই বেশি যে সারা বিশ্বের প্রায় 90 শতাংশ লেনদেন মার্কিন ডলার দ্বারা হয় ।। ভারত সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশ তাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে সোনার পাশাপাশি ডলারও মজুত করে রাখে, কারন সোনার দাম যেমন স্টেবল, অর্থাৎ হুট করে দাম বাড়ে বা কমে না,  ঠিক তেমনি ডলারের দামও হুট করে বাড়ে বা কমে না। এবার প্রশ্ন হল ভারত বা বাংলাদেশ নিজেদের মুদ্রা ছেড়ে কেন ডলার দিয়ে বিদেশি পন্য কেনে ? কেন ডলার সোনার মতই দামি ? আর কীভাবে ডলার এত শক্তিশালী একটি কারেন্সি হল। তো বন্ধুরা আমি মিঠুন রয়েছি আপনাদের সাথে আজকের প্রতিবেদনে ডলারকে সারা বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে আমেরিকার যে ষড়যন্ত্র ছিল তা আপনাদের জানাব।

Source - Wikipedia
Source – Wikipedia

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন বিশ্বের উন্নত দেশ যেমন ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি রাশিয়া এই দেশগুলির অর্থনীতি যুদ্ধের কারণে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু সেই মুহূর্ত আমেরিকা ছিল একমাত্র দেশ যাদের অর্থনীতির অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া তো দূরের কথা বরং অন্যান্য দেশগুলোর  তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। এর মূল কারণ হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা যুদ্ধে অংশগ্রহনকারি দেশ গুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আর রসদ বিক্রি করেছিল এবং তার মূল্য সোনার মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিল।  এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দেশগুলির অর্থনীতি কিভাবে পুনঃনির্মাণ করা সম্ভব এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর অর্থনীতি কিভাবে ঠিক করা যায় সেই বিষয় নিয়ে 44 টি দেশ আমেরিকার  Bretton  woods-এর একটি সভাতে মিলিত হয়েছিল।যা সারা বিশ্বের কাছে BRETTON WOODS conference নামে পরিচিত। এই সভাতেই International Monetary fund(IMF) এবং World Bank-এরকম বেশ কিছু সংস্থা তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়।

Bretton Woods Conference ( Source - Britannica )
Bretton Woods Conference ( Source – Britannica )

কিন্তু সেই সময়ে যেহেতু আমেরিকা ছাড়া বাকি সব দেশ গুলোর অরথব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল তাই আমেরিকা এই দেশ গুলোর কাছে একটি প্রস্তাব রাখে, তারা বলে এবার থেকে যখন একটি দেশ অন্য একটি দেশের সাথে ব্যবসা বানিজ্য করবে তখন আপনারা সোনার পরিবর্তে ডলারের মাধ্যমে পেমেন্ট করুন, এতে আপনাদের দেশের সোনা সুরক্ষিত থাকবে। আর এই দেশ গুলো তাদের সোনা আমেরিকার কাছে জমা রেখে সমান পরিমানে ডলার নিতে পারবে। এই সময়ে আমেরিকার এই প্রস্তাবে ব্রিটেন সবার প্রথমে সম্মতি জানায়। তখন বাকি ৪৩টি দেশও এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়, কারন আমেরিকার অর্থব্যবস্থা তখন সবথেকে শক্তিশালী ছিল। এই দেশ গুলো তাদের সোনা রেখে আমেরিকা থেকে ডলার নেয় এবং এই ডলার দিয়েই তারা বিভিন্ন দেশের সাথে কেনাবেচা করতে থাকে। ফলে ডলার ধিরে ধিরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

Source - fibre2fashion
Source – fibre2fashion

তবে ১৯৭০ সাল আসতে আসতে আমেরিকা তাদের ডলারের প্রিন্টিং নিজেদের ইচ্ছে মত করতে থাকে, যাতে তারা মার্কেটে আরও বেশি পরিমান ডলার পুশ করতে পারে। এই সময়ে বাকি দেশ গুলো এই নিয়ে আপত্তি জানায়। কারন ডলার যদি মার্কেটে বেড়ে যায় তাহলে তারা যে সোনা আমেরিকার কাছে রেখে ছিল তার দামও অনেক কমে যাবে।

১৯৭১ সালেই ফ্রান্স আমেরিকার কাছে নিজেদের সোনা ফেরত চায়। কারন তারা আর ডলারের উপরে ভরসা কর‍তে পারছিল না। আমেরিকা দেখে যদি ফ্রান্সের দেখা দেখি বাকি দেশ গুলোও তাদের সোনা ফেরত নিয়ে নেয় এবং ডলারের ব্যবহার বন্ধ করে দেয় তখন আমেরিকার অর্থব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, তখন আমেরিকা ফ্রান্সকে ডলারের বদলে সোনা ফেরত দিতে অস্বিকার করে।

আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সন ( Source - Insights )
আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সন ( Source – Insights )

1971 সালে যখন ফ্রান্স আমেরিকার থেকে ডলারের বদলে তাদের জমা রাখা সোনা ফেরত নিতে চাই তখন সেই সময়কার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরাসরি টিভিতে এসে  জানিয়ে দেন সোনা ফেরত দেওয়া হবে না,  এবং 15 ই আগস্ট 1971 সালে  ব্রেটন উডস সিস্টেমকে পুরোপুরি বাতিল করে দেন তিনি। তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন এখন থেকে সোনার বিপরীতে মার্কিন ডলার ছাপানো হবে না।। ডলারের মান নির্ধারিত হবে বাজারের চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে।। এ ঘোষণার পর পুরো পৃথিবীর জন্য আমেরিকান ডলারের মূল্য শূন্য হয়ে যায় এবং অন্যান্য দেশগুলো তাদের কাছে থাকা মার্কিন ডলার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন।। এই ঘটনার পর আমেরিকার কাছে সোনা গচ্ছিত রেখে ডলার নেওয়া দেশগুলি বিশাল পরিমাণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।। তাই সেই সময় নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন-কে সমস্ত দেশের রিজার্ভ থাকা আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে সেই দেশ গুলিকে কিছু না কিছু দিতেই হতো।এই সময়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সন এমন একটি ষড়যন্ত্র করেন, যার কথা শুনলে আপনারও মাথা ঘুরে যাবে

রিচারড নিক্সন এবং সৌদি আরবের রাজা ফায়সাল ( Source - Wikimedia Commons )
রিচারড নিক্সন এবং সৌদি আরবের রাজা ফায়সাল ( Source – Wikimedia Commons )

এই সময় আমেরিকার রাষ্ট্রপতির নজরে পড়ে সৌদি আরবের ওপর এবং তার মাথায় খেলে যায় এক বিরাট কূটনৈতিক বুদ্ধি ।। সৌদি আরব হলো এমন একটি দেশ যার কাছে প্রাকৃতিকভাবেই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তেলের খনি  আছে।।  সেই মুহূর্তে আরব ও ইজরায়েল এর মধ্যে সংঘটিত 6 দিনের যুদ্ধে আরব খুব খারাপভাবে হেরে গিয়েছিল।। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় সৌদি আরব নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছিলেন।। এই বিশেষ সময়ে সৌদি আরবে পৌঁছান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তিনি আরবের রাজা Faisal কে সৌদিতে থাকা তেল পুরো পৃথিবীতে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করার পরামর্শ দেন এবং তার পরিবর্তে আমেরিকা সৌদি আরবকে এবং সৌদি আরবের তেল ভান্ডারকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ।। এই একই প্রস্তাব আমেরিকা সেই মুহূর্তে OPEC-এর অন্যান্য সদস্য দেশগুলি কেউ দেন।। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা সৌদি আরব এই প্রস্তাব নাকচ করার স্পর্ধা না দেখিয়ে রিচার্ড নিক্সনের কথায় রাজি হয়ে যান ।। এতদিন পর্যন্ত যে সৌদিআরব আসল সোনার পরিবর্তে তাদের প্রাকৃতিক তেল বিক্রি করছিল এখন তারাই ওই তেল মার্কিন ডলারে বিক্রি করতে শুরু করেন।। যে ডলারের মূল্যমান ওই মুহূর্তে  শূন্য ছিল।।  এই ঘটনার মাধ্যমেই পৃথিবীতে জন্ম হয় পেট্রোডলারের(petrodollar)। এই পেট্রোল এর অর্থ হল  পেট্রোলিয়াম রপ্তানির মাধ্যমে একটি দেশের প্রাপ্ত মোট জাতীয় মুদ্রার পরিমাণ।। এই পদ্ধতির মাধ্যমে আরব দেশ গুলি পুরোপুরি আমেরিকার হাতে হয়ে যায়।।

Source - Medium
Source – Medium

এরপর সমগ্র বিষয়ে আলোকপাত করলে দেখতে পাবেন যে, কিভাবে আমেরিকা মূল্যমানের দিক দিয়ে শুন্য হয়ে যাওয়া মার্কিন ডলার কে পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্যমানে আবারও শীর্ষস্থানীয় করে তুলল।।

আরব দেশগুলো থেকে তেল কেনার জন্য অন্যান্য দেশগুলো তাদের কাছে রিজার্ভ করে রাখা মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে লাগলো এবং এই সুযোগে আমেরিকা মার্কিন ডলারের বিনিময়ে প্রাপ্ত সোনা মজুদ করে নিল আবারও এবং পূর্বের মজুত করে রাখা সোনা ফেতৎ ও দিতে হলোনা কোন দেশকে।।এরপর, 1973 সালে আবারও আরবের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শুরু হয়।। তখন এই যুদ্ধে আমেরিকা-ইসরাইলে কে সমর্থন করে ।। সেই মুহূর্তেই আমেরিকা ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পারে আরবের দেশগুলি, তারা বুঝতে পারে তাদের বোকা বানানো হয়েছে।। তা সত্ত্বেও এখনো তারা তাদের তেল ডলারের বদলে বিক্রি করে চলেছে।। কারণ তখন আমেরিকান ডলার বিশ্বের একমাত্র শক্তিশালী রিজার্ভ-এ পরিণত হয়েছে।।

Source - Press Tv
Source – Press Tv

এছাড়াও, আমেরিকার মতো একটি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করলে তার ফলস্বরূপ যেভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা সামলানো মত অবস্থা আরব দেশগুলির নেই।  আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল OPEC-এর দেশগুলোকে তাদের দেশের প্রাকৃতিক তেল আমেরিকান ডলারে বিক্রি করার জন্য বাধ্য করা।। যার জন্য আমদানি ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই আমেরিকান ডলারের ব্যবহার প্রতিটি দেশের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে থাকে।। সেই সময় থেকে এখনো পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানির সিংহভাগই মার্কিন ডলারে হয়।। অন্যান্য মুদ্রা গুলি এই ডলারের ধারেপাশেও নেই।। যেখানে মার্কিন ডলারের প্রতিদিনের লেনদেনের পরিমাণ প্রায় 90 শতাংশ সেখানে EURO 21%,YEN 6% প্রভৃতি ।। এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য মুদ্রাগুলি কোনভাবে ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না এখনও পর্যন্ত।। তবে পরবর্তী কালে কি হবে বা হতে চলেছে তা তো  সময়ের সাথেই জানা যাবে।।

তো বন্ধুরা বুঝলেনতো কিভাবে আমেরিকা বিশাল  ষড়যন্ত্র করে ডলারকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা বা World Reserve Currency তে পরিণত করেছে।। এই বিষয় সম্পর্কে আপনার মতামত কি তা জানাতে কিন্তু ভুলবেন না।।

ডলারের ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *