১৯৪১ সালে এক রাশিয়ান আরকিওলজিস্ট তইমুর লঙের কবর খুলেছিলেন, সেখানে তার কবরের উপর লেখা ছিল “ যখন আমি মৃত্যু থেকে জেগে উঠব তখন সারা পৃথিবী কাপবে” আর তার কফিনের উপরে লেখা ছিল, “ যে আমার কফিন খুলবে সে আমার থেকেও ভয়ানক কাউকে আহ্বান জানাবে” আশ্চর্য জনক ভাবে এই সমাধি খলার দুদিনের ভিতরেই হিটলার রাশিয়াতে আক্রমন করেছিল, এই হিটলারের জন্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রান হারায়।

তৈমুর লঙয়ের সমাধি ( Source - Owlcation )
তৈমুর লঙয়ের সমাধি ( Source – Owlcation )

পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দুর্ধর্ষ ব্যাক্তি এসেছেন, যারা মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, জাদের নির্মম ও বর্বরতায় কোটি কোটি মানুষ প্রান হারিয়েছে। তইমুর লঙ তাদের মধ্যেই একজন, দিল্লিতে যখন তইমুর লঙ আক্রমন করেছিল তখন প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে সে হত্যা করে, তাদের মৃত দেহ রাস্তায় ফেলে রাখে যাতে শেয়াল কুকুর ছিরে ছিরে খেতে পারে, তইমুর লঙ ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের হত্যার জন্য সরাসরি দায়ি ছিল।  কিন্তু কেন সে এই হত্যা কাণ্ড চালিয়েছিল, আর কেনই বা আক্রমন করেছিল ভারতে, নমস্কার বন্ধুরা আমি মিঠুন, আজকের প্রতিবেদনে তইমুর লঙের ইতিহাস ও তার শেষ পরিনতি কি হয়েছিল সে বিষয়ে জানাব

Timur Lang ( Source - The Global domain News )
Timur Lang ( Source – The Global domain News )

মঙ্গোল জনজাতি শুরু থেকেই বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল, তাদের একত্রিত করেছিল চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তার চার ছেলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়, এর মধ্যেই একটি সাম্রাজ্য ছিল চাগাতাই খানের, এই চাগাতাই সাম্রাজ্যের ভিতর থাকা বারলাস উপজাতিতে ১৩৩৬ সালে ৯ই এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন তইমুর লঙ। তার বাবা ছিলেন চাগাতাই সাম্রাজ্যের একজন সভাসদ, ছোটবেলা থেকেই তইমুর চেয়েছিল চেঙ্গিস খানের মত একজন শক্তিশালি সম্রাট হওয়ার, তইমুর শব্দের অর্থ আয়রন বা লোহা, আর লং শবদটি এসেছে ইংরেজি লেম শব্দ থেকে যার অর্থ পঙ্গু, তইমুর লঙ্গ শব্ধের অর্থ ল্যাংরা তইমুর, বলা হয় যখন তার ২০ বছর বয়স ছিল তখন তিরের আঘাতে তার  ডান পা ও ডান হাত বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, জেকারনে তার এমন নাম হয়ে যায়।  এটি সত্য প্রমান হয় যখন তার মৃতদেহ বিজ্ঞানিরা বাদিকের পায়ের কঙ্কালে চোট দেখেছেন এবং ডান হাতের দুটো আঙ্গুল ছিল না তাতে।

Timur Lang ( Source - BBC )
Timur Lang ( Source – BBC )

চেঙ্গিস খানের মতই তইমুর লঙ একজন অসাধারন যোদ্ধা ছিলেন এবং নিজের আক্রমনের পরিকল্পনা কয়েকবছ্র আগে থেকেই করে রাখতেন, ছোটবেলায় তিনি একটি চোরের দলের সাথে জুক্ত ছিলেন, কৃষক ও পথ যাত্রীদের টাকা পয়সা চুরি করে নিত। পরে সে অনেক সুলতানের সৈন্য দলে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেন এবং নিজের দক্ষতায় তিনি ধিরে ধিরে একজন সুদক্ষ সেনা প্রধান হয়ে ওঠেন। তখন তিনি ১০০০ সেনার একটি দল নিয়ে ইরানের উত্তর পশ্চিমে আক্রমন করেন এবং জিতে যান, ফলে তার প্রাধান্য দিন দিন বাড়তে থাকে মঙ্গোলদের মধ্যে, আর হত্যা লিলা ও বাড়তে থাকে।  তার এই ক্ষমতা বৃদ্ধি দেখে চাগাতাই সাম্রাজ্যের সুলতান বাধা দেয়, তখন তাকে হত্যা করে তইমুর ক্ষমতা দখল করে। ধিরে ধিরে সে তার শক্তিশালি সইন্যবলের দ্বারা আশেপাশের বহু সাম্রাজ্যকে দখল করে নেয়। তইমুর যেহেতু চেঙ্গিসখানের বংশধর ছিল না তাই সে খান উপাধি গ্রহন করতে পারেনি, আবার প্রফেট মহম্মদের বংশদ্ভুত না হওয়ায় তিনি খালিফা উপাধিও গ্রহন করতে পারেনি, তখন সে নিজেকে ঈশ্বরের দুত হিসাবে প্রচার করেছেন। তিনি বিজিত রাজ্য গুলোতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের তার অনুগত হওয়ার জন্য বলত, যারা অস্বীকার করত তাদেরকে হত্যা করে ফেলত। বলা হয় তইমুর লঙ একজন অসাধারন সেনা প্রধান ছিলেন তিনি জেকন যুদ্ধকে কিভাবে জয় করা যাবে টা তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝে জেতেন। তার দক্ষ সেনা বাহিনিতে অসংখ্য মঙ্গোল সৈন্য ছিল, যুদ্ধে জেতার পর সে পরাজিত রাজ্য থেকে লুঠ করা সব সম্পত্তি সৈন্যদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। ফলে সৈনিকরা তার প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। ধিরে ধিরে পারসিয়া, সিরিয়া, ইরাক, খুরদিস্তান, মামলুক সব রাজ্য গুল জয় করে ফেলে। এবং এখানে প্রচন্ড হত্যালিলা চালায়।

তৈমুর লঙয়ের রাজত্ব ( Source - Wikipedia )
তৈমুর লঙয়ের রাজত্ব ( Source – Wikipedia )

এদিকে দিল্লিতে তখন তুঘলক বংশের শাসনকাল চলছিল, দিল্লির গদিতে ছিল নাসিরুদ্দিন মাহমুদ তুঘলক, দিল্লিতে তখন গদি একটি অন্ত্রদন্দ চলছিল, ফলে সারা দেশ জুরে একটি রাজনৈতিক অরাজকতা চলছিল এবং সুলতান অতটা শক্তিশালি ছিল না, তইমুর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, বহুদিন ধরেই দিল্লির দিকে তইমুরের নজর ছিল, ভারত তখন ধন রত্নে ভরপুর এক দেশ ছিল, ফলে সুযোগ বুঝে আক্রমন করে তইমুর লঙ, ততদিনে একজন নির্মম শাসক হিসাবে তইমুর লঙের কুখ্যাতি বহুদুর পর্যন্ত ছরিয়ে পরেছিল।

Source - Historyanswers
Source – Historyanswers

১৭ই ডিসেম্বর ১৩৯৮ সালে তইমুর লঙ এবং মাহমুদ তুঘলকের ভিতর ভীষণ যুদ্ধ হয়, সেসময়ে মাহমুদের কাছে বিশাল হাতির বাহিনি ছিল, তইমুর এই হাতির দলকে পরাস্ত করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে একটা বড়ো গর্ত খুরে তা হাল্কা ছাউনি দিয়ে ঢেকে রেখেছিল, মাহমুদের হাতির দল সেই গর্তে পরে যায় এবং তইমুর লঙের নির্দেশে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মাহমুদ হেরে যায় এবং দিল্লি ছেরে পালিয়ে যায়, তইমুর ক্ষমতায় এসে যথেচ্ছ লুটপাট চালায়, যখন সাধারন মানুষরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রহ ঘশনা করে তখন সে সবাইকে গ্রেফতার করে এবং গন হত্যা চালায়, বলা হয় তিনি প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন, তাদের মৃতদেহ গুল রাস্তায় ফেলে রেখেছিলেন, যাতে শেয়াল কুকুর সেগুলকে খেতে পারে। তখন কার দিনে যুদ্ধে বাচ্চা ও মহিলাদের হত্যা করা হত না, তবে তইমুরের এই হত্যা কাণ্ডে দিল্লিতে পুরুষদের সংখ্যা অনেক কমে যায়, কিন্তু তইমুর বুঝেছিল অন্যান্য সাম্রাজ্য তাকে সমাদর করলেও সে ভারতে কখনই টিকে থাকতে পারবে না, তাই কিছুদিন শাসন চালানর পরে সে দিল্লি ছেরে চলে যায়, এবং নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারে আরও বেশি জোর দেয়, ১৪০০ সালে আর্মেনিয়া ও জরজ্রিয়া দখল করেন, সেখানে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের হত্যা করেন, ১৪০১ সালে সিরিয়া আক্রমন করেন এবং সেখানে ২০ হাজার মানুষের হত্যা করেন, ১৪০২ এ অয়ানাটলিয়া দখল করে এবং ৩০ হাজার মানুষের হত্যা করেন, এভাবে ধিরে ধিরে অগণিত মানুষের হত্যা দিয়ে তিনি মধ্য এশিয়ায় এক বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করেন। বলা হয় তিনি প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষের হত্যা করেছেন, যা সেসময়ে পৃথিবীর মোট জনস্সংখ্যার ৫ শতাংশ ছিল।

Source - Lookandlearn
Source – Lookandlearn

মধ্য এশিয়া জয়ের পর তার নজর যায় চিনের উপরে যখন তাকে চিনের সাম্রাজ্য অপমান করে তখন তিনি চিনের উপরে আক্রমন করেন, সেসময়ে চেঙ্গিসখানের বয়স ছিল ৬৮ বছর, ভুলবশত যুদ্ধের সময় হিসাবে তিনি শিতকালকে বেছে নিয়েছিল, যেখানে তিনি দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৪০৫ সালে মারা যান।  তার মৃতদেহ একটি কাল কফিনে করে কবর দেওয়া হয়, তার জন্মভুমি থেকে ৫০ মাইল উত্তরে কেশ নামক জায়গায়, তইমুরের ৪ ছেলে ছিল, তার দুই বড় ছেলে জাহাঙ্গির এবং উমার স্যাখ তার আগেই মারা গিয়েছিল, তৃতীয় ছেলে মিরান শাহ তার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই মারা যায়, ছোটছেলে সাহ রুখ তার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসাবে মনোনীত হয়।  তবে তার  মৃৃত্যুর পর তার তৈরি বিশাল সাম্রাজ্য কিছু সময়ের মধ্যেই ভেঙ্গে যায়। কারন মানুষের মনে তইমুরের জন্য শ্রদ্ধার থেকে বেশি ছিল ভয়, তাছারা তার কোন যোগ্য উত্তরাধিকার ছিল না। ফলে এই সাম্রাজ্য বেশিদিন টেকেনি। বন্ধুরা তইমুর লঙ একজন নির্মম ও বর্বর মানুষ ছিলেন, কেমন লাগলো এই প্রতিবেদনটি আমাকে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাও, প্রতিবেদনটি যদি ভালো লাগে তাহলে অবশ্যই একটি লাইক করে দিন, আর বন্ধুদের সঙ্গের শেয়ার করে দিন।

তৈমুর লঙ নিয়ে আমাদের ভিডিও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *